
পত্রিকায় আমাদের ছেলের ছবি ছেপেছে। সাথে আমাদের নাম ঠিকানাও উল্লেখ্য করা হয়েছে। তবে গর্ভধারিণী মা অথবা শ্রেষ্ঠ বাবা-মা হিসেবে নয়, একজন ধর্ষকের বাবা-মা হিসেবে।
আমাদের ছেলের যখন জন্ম হলো, সেদিন আমাদের পরিবারের আনন্দের শেষ নেই। ছেলে সন্তান হয়েছে যে! রাতুল জন্মানোর আগ পর্যন্ত ভয় হচ্ছিলো, যদি মেয়ে হয়! তাহলে যে শ্বাশুড়ি ও শ্বশুরবাড়ির কাছে আমার সম্মান থাকবে না! রাতুল সবার আদরেই বড় হতে লাগলো। শাসন বলতে কিছুই ছেলের ক্ষেত্রে করিনি। একটা ফুলের টোকাও দিতে দেইনি আমি।
আমার ছেলেকে কোনো ধরণের নৈতিক অথবা ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে বড় করিনি। ছেলে মানুষের এসব দিয়ে কী হবে আবার? বরং আমি আমার মেয়ের বেলায় তাকে খুব শাসনে বড় করেছি। মেয়ের চাইতে তিন গুন আহ্লাদে আমি আমার ছেলেকে আদরে বড় করি। সেজন্য অবশ্য আমার নিজের মেয়ের ই পরিবারে খুব একটা গুরত্ব নেই। মেয়ে দোষ করলেই তার গায়ে পর্যন্ত হাত তুলেছি। কিন্ত ছেলে সাত খুন করলে ও আমাদের কাছে তা মাফ! ছেলে মানুষ তো, একটু আধটু ভুল করবেই।
ছেলে যখন হাইস্কুলে উঠে, তার নামে নানা নালিশ আসা শুরু করে। ওই বয়সেই ছেলেটা আমার, মেয়েদের সাথে বাজে ব্যবহার করতো, রাস্তাঘাটে ইভটিজিং ও করতো।অবশ্য আমি ওসব কখনো গুরত্ব দেই নি। ছেলে মানুষ একটু তো দুষ্টুমি করবেই!
ছেলেটা আমার হাত ছাড়া হতে থাকে কলেজে উঠার পর থেকে। বাবা-মা হিসেবে ছেলে কার সাথে মিশছে, কী করছে তার কোনো খোঁজখবর নেই নি আমরা। তাকে দেয়া টাকা গুলো সে কীভাবে খরচ করতো তাও জানতে চাইনি কখনো। কিছুদিন আগেই মেয়েটা আমায় বললো এসে, রাতুল নাকি ক্যাম্পাসের মেয়েদের প্রচুর বিরক্ত করে, নানা মেয়েদের সাথে সম্পর্ক করছে। সেদিনে আমি আমার মেয়ের গালে কষে থাপ্পড় মেরে বলেছিলাম,
" ছেলে মানুষ প্রেম করতেই পারে। আর লোকজনের কথায় নিজের ভাইকে সন্দেহ করবি? এতো বড় সাহস কীভাবে হয় তোর মেয়ে? দু'দিন পর পরের বাড়ীতে চলে যাবি, তখন তো এই ছেলে ই আমাদের পালবে। আর কখনো নিজের ভাইয়ের পেছনে লাগার সাহস করবি না!"
বাড়ী ভর্তি লোকজন। প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সবাই এসে আমাদের দেখে ছিঃ ছিঃ করছে। সমাজ আমাদের একঘরে করার দাবী জানিয়েছে। ধর্ষকের বাবা-মা বলে কথা! কখনো আমরা ভাবিনি আমাদের ছেলে স্কুল পড়ুয়া কোনো কিশোরীকে ধর্ষণ করবে! আজ বহুদিন পর আমার উপলব্ধি হচ্ছে, কেন এরকম কুলাঙ্গার সন্তানকে জন্ম দিলাম আমি?
আমাদের ছেলের ফাঁসির সাজা হয়েছে। রাতুলের বাবা নানা উকিলের কাছে গিয়েও কেউ ধর্ষকের পক্ষে লড়তে চাইছে না। সমাজে এখন আমরা একঘরে হয়ে বাস করি। রাতুলের বাবার চাকরিটা ও আর নেই। এদিকে ঘরে বিবাহযোগ্য মেয়ে রয়েছে, ধর্ষকের বোন বলে তাকে কেউ বিয়ে করতে চায় না।
এখন সব যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। আজ মনে হচ্ছে, জন্ম দিলেই বাবা-মা হওয়া যায় না। আমরা জন্ম দিলে ও তাকে মানুষ করতে পারিনি। সব দোষ আমাদের ই। সন্তানকে মানুষ করার দায়িত্ব তো তার পরিবারের। অথচ আমরা ছেলে সন্তান হবার খুশিতে নিজের ছেলেকেই নষ্ট করেছি, দায়িত্বহীনতায় ছেলেকে কুলাঙ্গার বানিয়েছি৷ এজন্য ধর্ষকের বাবা-মা উপাধি না পাওয়ার জন্য ছেলে সন্তানকে যত্ন নিয়ে মানুষ করতে হবে। তাকে মানবিক, ধর্মীয় এবং নৈতিক শিক্ষা প্রদান করে অপর লিঙ্গের প্রতি কীভাবে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে সেই শিক্ষাটুকু দিতে হবে। যেন সে বীরপুরুষ হয়ে উঠে, কোনো কাপুরুষ নয়!
অমানুষ হয়ে উঠার গল্প
লেখা - মাহদিয়া
0 Comments