![]() |
ছবিটি লেখক আরিফ আজাদ এর তোলা |
দুনিয়াকে পরখ করে দেখবার তীব্র বাসনা থেকে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াবার একটা সংকল্প নিয়ে রেখেছি বহুদিন ধরে। যদিও বিদেশে যাওয়ার কোন সময় কিংবা সুযোগ- কোনোটাই এখনো মিলে নি, কিন্তু দেশের আনাচে-কানাচে যে সৌন্দর্য আর রহস্য লুকিয়ে আছে, তা আগে দেখে নেওয়ার ব্যাপারে আমি বদ্ধপরিকর। কবির কথাটা নিজের বেলাতে সত্য করে নিতে চাই না বলেই হয়তো-
'দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া'।
যশোরে একটা দাওয়াত ঝুলে ছিলো বহুদিন ধরেই। একটু সুযোগ হওয়াতেই উড়ে চলে গেলাম দাওয়াত রক্ষায়। এসে শুনি এখান থেকে অল্পকিছু দূরে, কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার এলাকাতে বেশকিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আছে, তা-ও আবার যে-সে নিদর্শন নয়, বহু পুরোনো আমলের রাজা-বাদশা কিংবা পীর-দরবেশদের নির্মিত মসজিদ যা গভির মাটি খনন করে আবিষ্কৃত হয়েছে।
পুরাকীর্তি! এমনিতেই নামটা জুড়ে একটা রহস্য রহস্য গন্ধ আছে, তারওপর সেসব পুরাকীর্তি যদি হয় কোন সুপ্রাচীন মসজিদের ভগ্নাবশেষ, এবং তাতে যদি লেপ্টে থাকে বহু পুরোনো কোন দরদী-ধার্মিকের দিলের ফরিয়াদ, তাহলে তো তা অবলোকনের বাসনা দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
কালীগঞ্জ উপজেলার সেই অঞ্চলের কখনো মেঠোপথ, কখনো পিচ-ঢালা রাস্তা ধরে একে একে দেখতে লাগলাম আজ থেকে পাঁচশো, ছয়তো, সাতশো এমনকি আটশো বছরেরও পুরোনো মসজিদগুলো যা বহু আগে এই অঞ্চলের মানুষ মাটির তলা থেকে আবিষ্কার করে মানুষের গোচরে এনেছে।
অবাক লাগলো, আধ-মাইল অঞ্চলের মাঝে দুটো, এমনকি তিনটে এমন পুরোনো মসজিদের সন্ধান মিললো এখানে। আরো মিলেছে সেই আমলের বাঁধাই করা কবরের দুটো পুরোনো কবরস্থান স্থানীয়দের ভাষায় যা ছিলো গণ-কবরস্থান। অতীতের কোন যুদ্ধ, কোন জিহাদ অথবা কোন শত্রুতা থেকে সংঘটিত কোন রক্তক্ষয়ী এক বিস্মৃত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে কালের লিপিতে টিকে গেলো এগুলো!
এতো কাছাকাছি জায়গায়, এতোগুলো দৃষ্টিনন্দন মসজিদ কেনো নির্মিত হলো সে এক রহস্য! তবে মসজিদগুলো খুব বড় নয়। একসাথে জনা-বিশ পঞ্চাশেক মানুষ সালাত পড়তে পারার মতোই।
আমার ধারণা, এই জায়গাটা সুদূর অতীতের কোন এক সময়ে হয়তো কোন ধর্মযাজকদের নগরী ছিলো। প্রতিটা মহল্লার জন্য তারা নির্মাণ করেছিলো একটা করে মসজিদ। সভ্যতার কোন এক সময়ে তাদের নগরী বিলুপ্ত হয়ে গেলেও মসজিদগুলো কিভাবে যে টিকে গেলো সে এক বিস্ময়!
হয়তো তারা তাঁবুতে বাস করতো, কিন্তু ইবাদাতের জন্য তারা নির্মাণ করেছিলো শক্ত ইমারত। তারা হয়তো ভাবতো, তাদের অতীত হওয়ার পরেও, নতুন কোন এক সভ্যতার, নতুন কোন এক সময়ের আগ্রহী পরিব্রাজকেরা এসকল মসজিদকে আবার আবাদ করবে। জিকিরের গুঞ্জনে, সালাতের মনোহরা দৃশ্যে আবারও ভরে উঠবে এসব জায়গা। হয়তো তাদের ধারণাই সত্যি হলো। তারা নেই আজ, নেই তাদের চিনতে পারার মতো কোন বংশধরও। কিন্তু মসজিদগুলো থেকে গেলো আগের মতোই। এখানে নতুন করে আবাদ হয়েছে রবের স্মরণের। আমিও যে এমন এক মসজিদে যোহর পড়লাম।
সবচেয়ে ভালোলাগার মুহূর্ত ছিলো, যে মসজিদটায় আমি যোহর পড়েছি, ওই মসজিদটি আজ থেকে পাঁচশো বছর আগের, কোন এক সুলতান বংশের বানানো মসজিদ ছিলো। মসজিদটি যখন মাটির তলা থেকে আবিষ্কৃত হয়, তখন সেখানে সুলতানী আমলের একটা তলোয়ার, এবং তখনকার সময়ে হাতে লেখা কুরআনের একটা কপিও পাওয়া গিয়েছিলো।
আমি নিজ হাতে সেই তলোয়ার ছুঁয়ে দেখেছি। যখন সেটি হাতে নিলাম, মনে হলো আমার শরীরে যেন বিদ্যুৎ চমক খেলে গেলো। সেই পুরাতন তলোয়ারের মরচে পড়া ধাতুমূল আমার ভিতরে মুহূর্তের জন্য কম্পন সৃষ্টি করেছিলো। কে জানে, কোন মহাবীর, মহাযোদ্ধার হাতে এই তলোয়ার একদিন মহা-প্রতাপে শোভা পেতো! আর অস্তিত্বের কোন এক কেন্দ্রে আমিও কি সেই অনুভূতি ধারণ করে চলেছি? তলোয়ারের রিনিঝিনি শব্দ যা চুরমার করে চলেছে শত্রুর সমস্ত অহংকার আর দর্প। মহাকালের স্রোতে সেই শব্দ কি তবে আমার বুকের ভেতরে দামামা বাজালো?
0 Comments