মানুষ বিমান বানিয়ে আকাশে উড়েছে, মহাশূন্যে ছড়িয়েছে তার কৃতিত্ব, মাটি খুঁড়ে পাতালে নেমেছে, চাঁদে পা রেখেছে এবং কম্পিউটার-বেতার আবিষ্কার করে সভ্যতার চেহারা পাল্টে দিয়েছে বলেই?



সম্ভবত এজন্যে নয় ঠিক।


এগুলোই যদি মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হয়, তাহলে এক মৌমাছির কাছেই বুদ্ধিমত্তার দিক দিয়ে মানুষ অনেক আগেই হেরে নাস্তানাবুদ হয়ে আছে। মৌমাছির জীবনচক্র যাদের জানা আছে তারা জানেন কি এক অসাধারণ প্রযুক্তি তারা ব্যবহার করে তাদের মৌচাক নির্মাণ থেকে শুরু করে মধু আহরণ করা পর্যন্ত। দৈনন্দিন জীবন-প্রক্রিয়ায় যে গাণিতিক সুক্ষ্ম হিশেব-নিকেষ তারা কষে, তা বুঝতে মানুষের দরকার পড়েছে যুগের পর যুগ সময়। কিন্তু কি অবলীলায়, কি উদাসীনভাবে মৌমাছি এই প্রযুক্তি, এই হিশেব-নিকেষের খেলা খেলে যায় তা অভাবনীয়!


আর, মৌমাছির সাথে আমাদের অস্তিত্বের সম্পর্কটা আরো জটিল। আমরা হয়তো জানিই না যে, প্রকৃতি থেকে যদি দৈবাৎ মৌমাছি বিলুপ্ত হয়ে যায়, মানবসভ্যতা ঠিক সেদিন থেকেই বিলুপ্তির দিনক্ষণ গননা শুরু করবে। প্রাণ-প্রকৃতিতে মৌমাছি নেই মানে আপনি আর আমিও নেই। একেবারে সোজা হিশেব।


প্রকৃতিতে মৌমাছির মতো এমন অসংখ্য প্রাণী আছে যাদের জীবন-কৌশল এতোই চমক জাগানিয়া যে, মানুষের বুদ্ধিমত্তা সেসবের কাছে দুধভাত হয়ে যাবে নিমিষেই।


কিন্তু তবুও, মানুষই সবচেয়ে সেরা বুদ্ধিমান প্রাণী। কেনো?


কারণ হলো, মৌমাছি কিংবা অন্য যেকোন প্রাণী তার অসাধারণ জীবন-প্রক্রিয়ার জটিল সমীকরণগুলো হাতে-কলমে শিখে না। তাদের জীবনকে আরো বৈচিত্রময় করতে নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কার তারা করতে পারে না। তাদের সেই প্রথম পূর্ব-পুরুষ যে কৌশল রপ্ত করেছিলো, যে জীবন-প্রক্রিয়ায় নিজেকে আত্মস্থ করেছিলো একদা, কিংবা যে জটিল জীবন-কৌশল নিয়ে একদিন ধরায় তার আবির্ভাব ঘটেছিলো, একেবারে শেষ উত্তর-পুরুষ পর্যন্ত, দুনিয়ার সর্বশেষ দিনেও তারা ওই একই কৌশল, একই প্রক্রিয়া এবং একই পদ্ধতিতেই বহাল থাকবে। পৃথিবীর একেবারে প্রথম মৌমাছিটার যে জীবন-প্রক্রিয়া ছিলো, পৃথিবীর শেষ মৌমাছিটারও সেই একই জীবন-পদ্ধতি।


কিন্তু মানুষ সেরকম নয়। সে তার আবির্ভাবের একেবারে শুরুতে যা ছিলো কিংবা যা জানতো, তা থেকে সরে এসে সে এগিয়ে গেছে বহু বহু দূরে। সভ্যতাকে সে নতুন মাত্রা দিয়েছে। নিজের জীবনকে আরো বৈচিত্রময়, আরো বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করতে নতুন নতুন প্রযুক্তি, নতুন নতুন কৌশল সে আবিষ্কার করেছে এবং করেই যাচ্ছে। এর কোনোটাই সে জন্মসূত্রে লাভ করে না।


তার সেরা হবার কারণ হলো এই, এগুলো সে মাথা কুটে বের করে। তাকে যে একটুকরো মগজ মাথার মধ্যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা দান করেছেন, তার সুষম ব্যবহার করে সে হাতিয়ার তৈরি করেছে।রেডিও-টেলিভিশন-বেতার-কম্পিউটার আবিষ্কার করে সে পাল্টে দিয়েছে সভ্যতার গতিপথ। সে উড়ো-জাহাজ আবিষ্কার করে আকাশে চড়েছে, জাহাজ আবিষ্কার করে সাগরের বুক চষে বেড়িয়েছে, দ্রুত গতির রকেট আবিষ্কার করেছে সে ভেদ করে গেছে পৃথিবীর অভিকর্ষজ বলকেও।


এসবের কোনোটাই সে তার আবির্ভাবের শুরুর দিন থেকে করতে পারেনি। সে সময়ের সাথে সাথে এসব রপ্ত করেছে এবং করছে। সামনে এমন আরো অনেক রহস্যের জাল সে উন্মুক্ত করবে যা সে আজকে বসে কল্পনাও করতে পারে না। সে কোনোকিছুই জন্মসূত্রে রপ্ত করে না, জন্মাবার পরে রপ্ত করে। সম্ভবত মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, সেরা বুদ্ধিমত্ত্বার প্রমাণটা ঠিক এখানেই।


মানুষের সেরা হবার আরেকটা কারণ হলো তার চিন্তা করবার স্বাধীন শক্তি। প্রাণী জগতে সম্ভবত আর দ্বিতীয় কোন প্রাণীর এই ক্ষমতা নেই। থাকলেও তা কোনোভাবেই মানুষের স্বাধীন চিন্তাশক্তির ধারেকাছেও আসতে পারবে না।


বৃষ্টি এলে যে পাখিগুলো হুড়মুড় করে নীড়ে ফেরে, সেই পাখির দলের কোন এক পাখির কি কোনোদিন মন চায় একটা দিন রিমঝিম বৃষ্টিতে ভিজতে?


আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় যারা, তারা কি কখনো সাদা মেঘ কিংবা অন্তহীন নীল আকাশ দেখে মুগ্ধ হয়?


ফুলের রেণু থেকে মধু সংগ্রহ করে প্রাণ এবং প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় নিয়োজিত যে মৌমাছি, সে কি কোনোদিন কোন এক মাতাল করা বুনো ফুলের গন্ধে বিভোর হয়েছে? কিংবা অবাক বিস্ময়ে থমকে দাঁড়িয়ে উপভোগ করেছে কোন এক আশ্চর্য বুনো ফুলের সৌন্দর্য?


সম্ভবত করেনি। এই অনন্য অনুভূতিগুলো একমাত্র, কেবলমাত্র এবং শুধুমাত্র মানুষের আছে। এখানেও মানুষ অনন্য।


এই যে এতো অনন্য-বৈশিষ্ট্যধারী মানুষ, তার যে এতো বৈচিত্র্যময় জীবন, এই জীবনটা মৃত্যুর সাথে সাথেই টুস করে শেষ হয়ে যাবে, তার এতো অর্থবহুল জীবন মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একেবারে অর্থহীন হয়ে পড়বে- এমন চিন্তা কিভাবে করা যায়?


সে এতো সুন্দর চিন্তা করতে পারে, সে অবাক হতে পারে, বিস্ময়ে বিভোর হতে পারে, সে বৈচিত্র‍্যে ভরে তুলতে পারে নিজের জীবন। এরপর, এই সবকিছুর শেষে একদিন মৃত্যু এসে ধরা দিলে সে নাকি একেবারে 'নাই' হয়ে যায়। এরপর নাকি কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার। সময়ের কোথাও নাকি তার জন্যে আর কোনোকিছুই বরাদ্দ নেই। আশ্চর্য না?


এতো আশ্চর্য ক্ষমতার এই জীবটাকে একদল মানুষ কেবল 'বায়োলোজিক্যাল প্রোডাক্ট' ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না। জন্মেছে, খেয়ে-পরে আর আত্মরক্ষা করে বেঁচেছে, এরপর মরে গেছে আর নাই হয়ে গেছে, ব্যস!


কিন্তু আমরা অতি-আশ্চর্য ক্ষমতার এই জীবটার জন্যে আরো একটা জগতে বিশ্বাস করি। দুনিয়ার জীবনকেই তার অর্থবহুল জীবনের সমাপ্তি বলে মনে করি না। আমরা বিশ্বাস করি, তার এই যে এতো আশ্চর্য চিন্তার ক্ষমতা, এই ক্ষমতা যার প্রদত্ত, তার বিধান-মতো যদি সে জীবন অতিবাহিত করে, তাহলে সময়ের কোন এক প্রান্তে তার জন্যে এমনসব পুরষ্কার বরাদ্দ রাখা আছে যা দেখে সে এতো বেশি, এতো অধিক বিস্মিত হয়ে পড়বে যে, দুনিয়ার সব মুগ্ধতাকে তার কাছে নস্যি মনে হবে।


আমরা বিশ্বাস করি, সময়ের আরো একটা মাত্রায়- যার নাম আখিরাত- আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে আরো একটা জীবন। আর সেই জীবনের ভিত্তিমূল প্রোথিত আছে এখানে। দুনিয়ার জীবনে।